মুজিব কমিক্স জাপানে!

কিছুদিন আগে সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি জাপানের অভ্যর্থনায় জাপান ঘুরে আসার। উদ্দেশ্য জাপানের রাজধানী টোকিওতে আমাদের গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’-এর জাপানিজ সংস্করণের প্রকাশনা উৎসবে অংশগ্রহন করা।এই প্রথম কোন বাংলা কমিক্স মাঙ্গার দেশে পা রাখলো। আর জাপানিজ ভাষায়ও এই প্রথম কোন বাংলা কমিক্সের পদচারনা। তাই ভাবলাম মিয়াজাকি আর ওসামু তেজুকার দেশে আমাদের এই বাংলা কমিক্স অভিযানের গল্পটা লিখে ফেলা যাক।

টোকিয়োতে নেমে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন নিয়ে বন্ধু শশির বাসায় যাচ্ছি। প্রকাশনা উৎসবের আগে হাতে কয়েকদিন আছে টোকিও ঘুরে দেখার। সাবওয়েতে বসেই সবার আগে যেটা চোখে পড়লো সেটা হচ্ছে যেসব মানুষজন মোবাইলে ব্যাস্ত, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই গেইম খেলছে অথবা মাঙ্গা অ্যাপ-এ কমিক্স পড়ছে।
ঘটনাটা আমার জন্য একটু অদ্ভুত। পৃথিবীর আরো যেসব দেশ ঘুরেছি, সেসব জায়গায় কমিক্স, কার্টুন এগুলা হচ্ছে একেকটা সাব কালচার। তাই প্লেন থেকে নেমেই টোকিও শহরের দৈনন্দিন জীবনে যে কমিক্স কালচারের চর্চা দেখতে পারবো তা চিন্তা করিনি।

আমার বন্ধু শশি থাকে নিজার সাইতামা এলাকায়। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার পর সে জানতে চাইলো যে এই কয়দিন আমি কই কই ঘুরতে চাই। (আসলে দুই মাস আগে থেকেই জানতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি) আমি গড়গড় করে বলে চললামঃ স্টুডিও গিবলি মিউজিয়াম, আকিয়াবারা, মাঙ্গা ক্যাফে, মান্দারাকে ইত্যাদি ইত্যাদি (মূলত গুগল করে টোকিওর মাঙ্গা কালচার সম্পর্কে যা যা জেনেছি আরকি!)
শশি বিরক্ত হয়ে বললোঃ হাজার মাইল পার করে এত দূর এসেছিস এসব কমিক্স-টমিক্স ছাড়া আর কিছু দেখবি না?
ঃ তাতো দেখবোই। এগুলা প্রায়োরিটি আর কি। আর এছাড়া আমার মন্দির-মসজিদ দেখতে বেশ ভালো লাগে আর ভালো লাগে নতুন শহরের পুরোনো অলিগলিতে ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে এরকম আরো ঐতিহাসিক জায়গা-টায়গা যা পারিস ঘুরে দেখাস।
শশিকে আমার চয়েজ অব প্লেস নিয়ে খুব একটা এক্সাইটেড হতে দেখা গেলো না। ছোটবেলা থেকেই তার ইতিহাস-টিতিহাসের দিকে নজর একটু কম, খুব একটা জমে না। খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর বলে গেলো জলদি করে ঘুমিয়ে পর, ঘুরতে হলে কাল খুব সকাল সকাল উঠতে হবে।
আমরা প্রথমদিন গেলাম আকিয়াবারাতে। আকিয়াবারা হচ্ছে টোকিওর ইলেক্ট্রনিক্স আর মাঙ্গা-এনিমে হাব।
এক কথায় জায়গাটা ভিডিও গেমস, এনিমে প্রেমী আর মাঙ্গা পড়ুয়াদের জন্য স্বর্গ রাজ্য।একটা পুরো এলাকা জুড়ে শুধু শয়ে শয়ে এসবের দোকান। দোকান বললে আসলে জায়গাটার গ্রাভিটি টাকে বোঝানো যাবে না।

যেমন ধরো একটা মাঙ্গা কমিক্সের দোকান ‘মান্দারাকে।’ সেটা দেখে তো আমি পুরা ‘থ’। আমাকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কি হয়েছে শশি জিজ্ঞেস করলে আমি অবাক হয়ে বললাম, দোস্ত এতো পুরা আমাদের ইস্টার্ন প্লাজার সমান! সেগা ভিডিও গেইমের শো রুম দেখলাম সেটাও মোটামুটি আমাদের বসুন্ধরা মার্কেটের মত বড়!

একটা গল্প আছে না, যে এক লোক প্রথম অজপাড়াগাঁ থেকে শহরে এসেছে। শহর দেখে গ্রামে ফেরত যাওয়ার পর গ্রামবাসী যখন তাকে জিজ্ঞাসা করছে শহরের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিংটা কত বড়? সে উত্তর দেয় তাদের গ্রামের সব চেয়ে বড় যে খড়ের গাদাটা আছে সেটার সমান। আবার যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে শহরের সবচেয়ে উঁচু মিনারটা কত বড়? উত্তর সেই একই। গ্রামের সব চেয়ে বড় যে খড়ের গাদাটা সেটার সমান।
তো জাপানের এসে আমারও সেই একই অবস্থা।আসলে মাঙ্গা-এনিমে ইন্ডাস্ট্রির স্কেলটা চোখে না দেখলে ধারণা করাটা একটু কঠিন।
তো আমরা আকিহাবারায় ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এত লাখ লাখ মাঙ্গা চারপাশে কিন্তু সব জাপানিজ ভাষায়। ইংলিশ সেকশনও ছিল কিছু কিন্তু তা বেশ অবহেলিত ও সংখায় খুবই কম। আমার দুঃখ দেখে বন্ধু শশি সুর করে করে জাপানিজ মাঙ্গা আমার জন্য বাংলায় অনুবাদ করে করে পড়া শুরু করলো।
আমিও সে অত্যাচার থেকে বাঁচার তাগিদে তাড়াতাড়ি কালেকশনে রাখার জন্য ও গিফট করার জন্য তাড়াহুড়া করে কিছু মাঙ্গা কিনলাম।কাতসিহিরু অকোমোর আঁকা “আকিরা” মাঙ্গাটাও অনেকদিন ধরে খুজছিলাম। সে শখটাও এ যাত্রায় পূর্ণ হলো।
সবচেয়ে যেটা মনে গেঁথে গেলো, সেটা হচ্ছে মাঙ্গার দোকানে সারি সারি মাঙ্গা কমিক্সের শেলফের মাঝে কিশোর থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের যে অনবরত মাঙ্গা পড়ার অভ্যাস। র্যান্ডমলি একটা কর্ম দিবসে একটা কমিক্সের দোকানে এত মানুষের আনাগোনা হতে পারে সেটা আমার দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিলো না।
আর তখন আমি আসলে বুঝতে পারলাম অন্যান্য দেশের মত কমিক্স বা মাঙ্গা জাপানের কোন উপসংস্কৃতি নয় বরং এটা তাদের সংস্কৃতি!

পরের কদিন আসাকুসার সেনসো জি’র মন্দির, রয়াল প্যালেস, বিশ্ব বিখ্যাত শিবুইয়া স্কয়ার আর সিনজুকুতে গডজিলার মাথা দেখলাম। খাবার দাবারের কথা বললে বলা যায় যে সেটা এই টোকিও ট্রিপের প্রধান আকর্ষণ ছিল। এত পদের আর ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা যে একসাথে হতে পারে তা আসলে জাপান না আসলে বোঝা যেত না। গলির চিপার ইয়াকেতোরির দোকান থেকে শুরু করে ফ্যান্সি রেস্টুরেন্টে কোবে বিফ খাওয়ার অভিজ্ঞতা সব এই ট্রিপেই হলো। টাকোয়াকি-ফুচকার মতো দেখতে অক্টোপাসের চপ থেকে শুরু করে রামেন, সোবা, মোঞ্জায়াকি ইত্যাদি। কিন্তু এসবের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল কনভেয়র বেল্ট সুশির দোকান গুলো। যেখানে যে যার টেবিলে বসে থাকে আর এয়ারপোর্টের লাগেজ বেল্টের মত (কিন্তু ছোট) বেল্টে করে অটোমেটিক নানা পদের সুশি আসতে থাকে কাস্টমারদের সামনে। ইচ্ছা মত খেয়ে নাও, পরে প্লেটের রঙ দেখে হবে হিসাব টাকার।






টোকিও আসলে একটা এত ব্যয়বহুল শহর যে আমাদের ট্রিপের সব কিছু ফান্ডেড হওয়ার পরও হালকা টুকিটাকি খাওয়া দাওয়া আর কেনাকাটা করতেই জান বের হয়ে যাচ্ছিল। সিঞ্জুকু তে সিকাইদো নামের একটা আর্ট ম্যাটেরিয়াল শপ খুঁজে বের করেছিলাম ব্যাগ ভরতি করে জাপানিজ আর্ট ম্যাটেরিয়াল কিনে নিয়ে যাবো বলে। পরে খুব বেশি কিছু কিনতে পারিনি। বন্ধু বান্ধবদের জন্য কিছু ব্রাশ পেন আর কালি কিনতে কিনতেই পকেট ফাঁকা। বিশাল এক দোকান সিকাইদো। সাইজ বোঝাতে আবার বলতে হয় আমাদের সেই ইস্টার্ন প্লা…থাক। আপনারা বুঝে নিতে পারলেই হলো। ফ্লোরে ফ্লোরে সারি সারি আর্ট ম্যাটেরিয়ালস। দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের দেশে যদি এরকম একটা থাকতো!
এত এক্সপেন্সিভ শহর হওয়ার পরও এমন এক ধরনের জায়গা পেলাম যেখানে এত কম খরচ যে তা শুনে আমার শায়েস্তা খাঁ-এর আমলের কথা মনে পড়ে গেলো। জায়গাটা হচ্ছে মাঙ্গা ক্যাফে। আমাদের ঢাকার অলিতে গলিতে যেমন একটা সময় সাইবার ক্যাফে ছিল ঠিক একই ঢঙ্গে টোকিওর অলিতে গলিতে দেখা মেলে এসব মাঙ্গা ক্যাফেগুলোর। শুধু পার্থক্য হচ্ছে এই ক্যাফেগুলোতে ইন্টারনেটের বদলে ঘণ্টা হিসেবে মাঙ্গা পড়া কিংবা এনিমে দেখার জন্য ভাড়া দেয়া হয়। প্রতি ঘন্টা বাংলাদেশি টাকায় ছেলেদের জন্য ২০০ টাকা আর মেয়েদের জন্য ১০০টাকা। ভাবা যায়?! কমিক্স আর এনিমে যে জাপানের তরুণদের শিরায় শিরায় বিরাজ করে এটা যেন তার আরেকটা পরিষ্কার উদাহরণ। আরো অবাক ব্যাপার হচ্ছে ২০০ টাকায় শুধু বই আর জায়গা না সাথে ভেন্ডিং মেশিনের অফুরন্ত কফি জুস সব ফ্রি। সন্ধাটা মাঙ্গা আর কফি নিয়ে বেশ আরামে কাটলো।




২৬ তারিখ ছিল বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি জাপানে আমাদের মুজিব গ্রাফিক নভেলের জাপানিজ সংস্করনের প্রকাশনা উৎসব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সি আর আই এর ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা, এম্বাসেডর রাবাব ফাতিমা, মুজিব গ্রাফিক নভেলের এডিটর শিবু কুমার শিল, জাপানিজ ভাষায় অনুবাদক সেনসে ওহাসি সহ টোকিওর বাংলাদেশি কমিউনিটির আরো অনেকে।

অনুষ্ঠানটি আরো আনন্দময় হয়ে উঠলো যখন জাপানের প্রধানমন্ত্রির স্ত্রী আকিয়া আবে উদ্বোধনী পর্বে অংশগ্রহন করলেন। সবাই অল্প অল্প করে বক্তব্য রাখলেন। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও আমাদের গ্রাফিক নভেলের প্রকাশক ববি ভাই বললেন কিভাবে তিনি তার নানার জীবনের ওপর এই বায়োগ্রাফিকাল গ্রাফিক নভেলের কাজে হাত দিলেন। আমিও আমার বক্তব্যে গ্রাফিক নভেলটি আগামী বছরের মধ্যে সম্পুর্ণ করার কথা দিলাম। গ্রাফিক নভেলটির আপাতত ৬ টি পর্বের কাজ শেষ হয়েছে এবং আরো ৬টি পর্বের কাজ চলছে।

অনুষ্ঠান শেষে খাওয়া দাওয়া পর্বে পরিচয় হল মাঙ্গা আর্টিস্ট কুরানিশি ইয়াশীকোর সাথে।কুরানিশি আমার জন্য নিয়ে এসেছিলেন তার আঁকা মাঙ্গা সিরিজের দুটি কপি। ভীষন বিনয়ী কুরানিশি। তার মাঙ্গার ক্যারেক্টার ইয়াশি তিব্বতের পাহাড় ঘুরে ঘুরে অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ায়। অসম্ভব দক্ষতার ছাপ সেসব কাজে। আমি সবসময় দেখছি যে শিল্পীরা যত উঁচু মাপের হন তারা ততই বিনয়ী হন। পরেরদিন লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করে একটা ডিটেইল ভিডিও ইন্টার্ভিউ নিয়ে নিলাম কুরানিশির। কিভাবে কাজ করেন, মাঙ্গা মার্কেটে ঢোকার উপায়, মোট কথা জাপানের মাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রির আদ্যোপান্ত! পাশাপাশি কুরানিশি জয়েন করলেন কার্টুন পিপল আর আমাকে জয়েন করালেন তাদের আঁকাআঁকির গ্রুপ।




পরের দুইদিন ছিল জাপানের দুইটা স্কুলে আমাদের মুজিব কমিকবুক রিডিং সেশন। সেন্সে ওহাসি স্কুলের বাচ্চাদের জাপানি ভাষায় কমিক্সটি পরে শুনালেন। আমি হাতে কলমে তাদের ‘মুজিব’ ক্যারেক্টারটি কিভাবে আঁকতে হয় তা শিখালাম। তারাও বাংলায় প্ল্যাকার্ড লিখে আমাদেরকে স্বাগতম জানালো তাদের স্কুলে। এই সব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে যে বিষয়টা স্মরণীয় হয়ে থাকলো তা হলো একদল ভীনদেশী বাচ্চাকাচ্চা এই কমিক্সের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় নেতার গল্প শুনলো। সেশন শেষে এক বাচ্চা দাঁড়িয়ে বলেছিলঃ এরপর আমার যখন কোন বাংলাদেশী বন্ধু হবে তাকে আমি বলবো আমি তোমাদের মুজিব কে চিনি। আমি হাসতে হাসতে তাকে উত্তর দিলাম তাহলে সে তাৎক্ষণিক তোমার বন্ধু হয়ে যাবে।


প্রকাশনা উৎসব শেষ হবার পর আরো দিন চারেক ছিলাম টোকিওতে। সে সপ্তাহের স্টুডিও গিবলির মিউজিয়ামের টিকিট নাকি ৩ মাস আগে থেকে হাউজফুল ছিল। তাই এ যাত্রায় আর স্টুডিও গিবলির মিউজিয়াম দেখা হলো না। তার বদলে টোকিও মিউজিয়াম আর ইউএনও পার্ক ঘুরে বেড়ালাম। টোকিও মিউজিয়াম ঘুরতে গিয়ে আমার আর শিবুদার নরওয়েজিয়ান পেইন্টার এডওয়ার্ড মুঙ্ক এর এক্সিবিশন আর তার বিশ্ববিখ্যাত পেইন্টিং “স্ক্রিম” দেখার সৌভাগ্য হলো ।


এরপরও দিন রাত সারাদিন ঘুরেও সুমো টুর্নামেন্ট, টোকিও কমিকন আরো যা যা দেখবো ভেবেছিলাম তার অনেক কিছুই মিস হয়ে গেলো। তবে কিছু কিছু জিনিস নাকি মিস হয়ে যাওয়া ভালো। কারণ আমার বাবা বলতেন তাহলে নাকি সে জায়গায় আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাটা থেকে যায়। আর জাপানে তো ফিরে আসতেই হবে কারণ মুজিবের তো এখনো ৬ টা পর্ব বাকি! (সমাপ্ত)

