স্কেচবুকিং কি কেন কিজন্য?
প্রায় প্রতিদিনই আমাকে অনেকে স্কেচবুকিং জিনিশটা কি সেটা বুঝিয়ে বলার জন্য বলে। অনেকের অনেক প্রশ্ন থাকে, তাই পুরা ব্যাপারটাকে এখানে একসাথে লিখে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো।
স্কেচ বুক কি?
প্রথমে আসি স্কেচবুকে, স্কেচবুক জিনিস কি সেটা জানলে আসলে স্কেচবুকিং ব্যাপারটা আরো ক্লিয়ারলী বোঝা যাবে। স্কেচবুক হচ্ছে একজন আর্টিস্টের রাফ খাতা বা আঁকার ডায়রী। ইয়েস! রাফ খাতা! পোর্টফোলিও নয়, পরিস্কার এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার খাতা নয়, ক্লাসের নীট এন্ড ক্লিন খাতা নয় বরং রাফ খাতা কিংবা ডায়েরী! যেখানে আমরা হিবিজিবি আঁকি বা লিখি। ডায়রী যারা লেখে তারা যেমন সেটাকে রেগুলার মেইনটেই করে, প্রতিদিনের ঘটনা সহ দরকারি জিনিস পত্র যেমন বাজারের ফর্দ বা প্লানিং টুকটাক লিখে রাখে, স্কেচ বুকও আর্টিস্টদের জন্য হচ্ছে সেরকম একটা ডায়েরী। দুনিয়াটাকে তুমি যেভাবে দেখছো কিংবা বুজছো সেটাকে সেরকম ভাবে এঁকে ও লিখে রাখার খাতাই হচ্ছে স্কেচবুক।

রেগুলার একটা স্কেচবুক মেইন্টেন করা, একজন আর্টিস্ট হয়ে গড়ে ওঠার পথে বিশাল ভুমিকা পালন করে।
স্কেচবুকে কখন আঁকবো কিভাবে আঁকবো?
এই স্কেচবুকে আঁকার প্রথম শর্ত হলো স্কেচবুকটাকে সবসময় সাথে রাখা আর প্রতিদিন আঁকা।

সাথেই যদি না থাকে তাহলে প্রতিদিন আঁকবো কিভাবে তাই না? আর তাই স্কেচবুকটার সাইজ সবসময় ছোট হলে ভালো যাতে সবসময় হাতে কিংবা ব্যাগের মধ্যে ক্যারি করা যায়।আর হার্ড বাইন্ডিং হলে আরও ভালো ফলে নেতিয়ে যাবে না, দাঁড়িয়ে বা বসে বাসে, রাস্তায় যে কোন যায়গায় আঁকা যাবে। হয়তো ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে মা কে নিয়ে বসে আছো কিংবা জ্যামে সিএঞ্জির মধ্যে, যে কোন সিচুয়েশনেই স্কেচ বুকটা থাকলে টুক করে বের করে একটা আইডিয়া বা ড্রইং এঁকে বা লিখে ফেলা যায়। ফলে বোরিং ও লাগে না আবার মাথায় সদ্য আসা আইডিয়া বা সদ্য দেখা ড্রিইং টাও সুন্দর করে নোট করে নেয়া যায়!
স্কেচবুকে এভাবে রেগুলার আঁকাআঁকি করাটাকেই স্কেচবুকিং বলে।
স্কেচবুকে কি কি আঁকবো?
আগেই যেহেতু বলেছি স্কেচবুক হলো হিবিজিবি আঁকার রাফ খাতা তাই স্কেচবুকে কি আঁকবো সেটা টোটালী আর্টিস্ট কিভাবে নিজেকে ডেভেলপ করতে চায় তার ওপর নির্ভর করে। কমিক আর্টিস্ট বা কার্টুনিস্ট হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট সেট অফ প্রাক্টিস ফলো করা যায় স্কেচবুক করার ক্ষেত্রে। যেগুলো ফলো করলে সহজে ছবিতে গল্প বলার জন্য যে স্কিল গুলো দরকার সে গুলো ধিরে ধিরে তৈরী হয়। সেই প্রাক্টিস গুলো সম্পর্কে নিচে বর্ননা করা হলোঃ
নাম্বার ১ঃ জেশ্চার ড্রইং বা কুইক ড্রইং।
মানুষের শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গিই হচ্ছে জেশ্চার বা ভঙ্গিমা।
একটা মানুষ কিভাবে হাটে কিভাবে বসে কিভাবে লাফায়, (সেই জেশ্চার, সেই পশ্চার (!) অথবা তার শরীরের সেই এসেন্সকে) পেন্সিলের লাইনে ধরে ফেলাটাকেই জেশ্চার ড্রইং বলে।

আমরা একটু বুক টান টান করে, মেরুদন্ড সোজা করে করে একবার দাঁড়াই। এখন চিন্তা করে দেখি সাধারনত কি আমরা কখনো এভাবে দাঁড়াই? উত্তর আসবে যে না। বেশীর ভাগ সময়ই আমরা এঁকে বেঁকে, ঝুঁকো হয়ে, শরীর ছেড়ে দিয়ে, এক পায়ে ভর দিয়ে, নানা নকশা করে দাঁড়াই।
তাহোলে আঁকার সময় সেই সদা টান টান আরামে দাঁড়াও পজিশন আঁকি কেন?
আঁকি কারন আমরা অব্জার্ভ করি না। আর তাই আমাদের ওই আঁকা গুলো বিশ্বাসযোগ্য হয় না। জেশ্চার ড্রইং আমাদের হরেক রকম মানুষের অঙ্গভঙ্গি মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করতে ও আঁকতে শেখায়। তাই পরে যখন আমরা কোন ছবিতে মানুষজন আঁকি সেগুলো তখন আর ফ্লউইড ও বিশ্বাসযোগ্য লাগে।
জেশ্চার ড্রইং তো বুঝলাম এবার কুইক ড্রইং কি?
জেশ্চার ড্রইং টাই যখন জলদি ১০-১৫ সেকেন্ডে একে ফেলা হয় তখন একে বলে কুইক ড্রইং। রাস্তা ঘাটে, ক্যাফেতে যেখানেই যেকোন মানুষের জেশ্চার আঁকতে যাওনা কেন, মানুষ জন হাঁটা চলা বা মুভমেন্ট এঁর মধ্যে থাকে। তাই ঝটপট না আঁকলে কখনই তার জেশ্চারটা ধরা সম্ভব না। আবার আরেকভাবে বললে অনেক সময় নিয়ে আঁকতে গেলে মনোযোগ সাব্জেক্টের ডিটেইলের দিকে চলে যায় কিন্তু ঝটপট আঁকলে শুধু জেশ্চারটা ছাড়া অন্যকিছু আঁকাও সম্ভব হয় না। তাই কুইক জেশ্চার ড্রইং ইজ আ গুড প্রাক্টিস!

Gesture and quick drawing practice বোঝার জন্য আমাদের কার্টুন পিপল ইউটিউব চ্যানেলে বিভিন্ন জায়গা থেকে কালেক্ট করে একটা প্লে লিস্ট বানানো আছে। এটা দেখে ব্যাপারটা আরো ভালো বুঝতে পারা যাবেঃ
https://www.youtube.com/watch?v=74HR59yFZ7Y&list=PLW2pssyTsYHIfSX6BBKTFWO3rW5W_sn9B
নাম্বার ২ঃ ক্যারেকটার স্টাডিঃ
জেশ্চার ড্রইং প্রাক্টিস এর পর আসে ক্যারেকটার স্টাডি। এই লোকটা কেমন> মোটা, চিকন, রাশভারী? পুরান ঢাকার লোকেরা লুঙ্গি কেম্নে পরে? আর বেদেনি রা শাড়ি?
দিন মজুরদের কাপড়ের স্টাইল কেমন হয়? বেসিক্যালী এখানে আমরার এখন শুধু আর জেশ্চারে না থেকে তার সাথে ক্যারেকটারের দাড়ি, গোফ কাপড় চোপড়ের দিকে তাকাচ্ছি। মনে রাখতে হবে একটা লোক কিভাবে হাঁটে-সেই জেশ্চারও তার ক্যারেকটার এঁর একটা অংশ। এভাবে প্রতিদিনকার লাইভ স্কেচবুকিং এ আমরা আমাদের চারপাশের মানুষ জন কে নিজের মতো করে খাতায় কপি করি। আর পরবর্তী তে কোন কার্টুনে যখন এরকম একই ধরনের ক্যারেকটার দরকার হয় তখন তা স্কেচবুক টা খুলে নিয়ে দেখে কপি করি। এভাবেই কমিক/ কার্টুনের জন্য নতুন ক্যারেকটার তৈরি হয় আর এভাবেই আন্দাজে আঁকা থেকে সরে এসে রিয়েল লাইফ থেকে ইন্সপায়রেশন নিয়ে আমরা নানা রকম ক্যারেকটার তৈরী করা শুরু করি।
নাম্বার ৪ঃ ব্যাকগ্রাউন্ড এন্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিঃ
ক্যারেকটার স্টাডির পর বা পাশাপাশি চলতে পারে ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি। ধরো তোমার কমিকে প্রটাগনিস্ট সাহাবাগ মোড়ে হেভী মারামারি শুরু করলো। গুগলে সাহাবাগ মোড়ের ঠিক যেই ছবিটা চাচ্ছো সেটা পাচ্ছো না। এতবার ওই রাস্তা দিয়ে গেছো তাও একটুও সিনারিয়ো টা মনে করে আঁকতে পারছো না, এখন উপায়?
উপায় হচ্ছে স্কেচ বুকিং এ নিজের দেশে বা শহরে যত যায়গায় যাবা সেসব এলাকা কে খুব কমের মধ্যে সিমপ্লী স্কেচ বুকে স্টাডি করে রেখে দিবা। একা একা ঘোরা হয়ে ওঠে না? এজন্যই Cartoon People থেকে আমরা প্রতি সপ্তাহে #SketchbookSaturday একএকটা ডিফারেন্ট এলাকায় করি। এভাবে আস্তে আস্তে স্কেচবুকে ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডী করলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখবা তোমার নিজের একটা রেফারেন্স লাইব্রেরী দাঁড়ায় গেছে। এখন কমিকে ঢাকার সাহাবাগ হোক কিংবা চট্টগ্রামের জি ই সি মোড়, তোমার হিরো ফাটায় দিবে! :D

ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডির সময় কিছু কিছু ব্যাপার মাথায় রাখা যেতে পারেঃ
* ব্যাকগ্রাউন্ড ডিটেইলে কিংবা পৃষ্ঠা জুড়ে আঁকার কোন প্রয়োজন নেই। র্যাদার ছোট ছোট থাম্ব নেইলিং করে সিম্পল ফর্ম আর শেইপে এক্সপ্লোর করলে পরে বেশী কাজে দিবে।
যেমন ধরো এঁকেছিলাম ধান্মন্ডি লেকের পাশের গাছগুলা কেমন হয়। একটু খেয়াল করে গাছ গুলার ডিজাইন ধরতে পারাতেই কিন্তু এটা আরও সহজে ধান্মন্ডি লেক বোঝা যাচ্ছে। লেকের প্যাডলিং বোট গুলাও কিন্তু এই ব্যাকগ্রাউন্ড বা এনভায়রনমেন্ট ডিজাইনের একটা অংশ।

টি এস সি এলাকার মেইন আইডেন্টিটি বা চোখে পড়ার মত বিষয় গুলো কি কি? — ধরো রাজু ভাস্কর্জ আর চায়ের দোকান গুলো এঁকে নিলাম।
সদরঘাটে সবাই মিলে স্কেচবুক স্যাটারডে তে গেছি, দশটা নৌকা একসাথে রাখা থাকলে একটা পদ্মফুলের শেপ হয় — এঁকে রাখলাম।
পুরান ঢাকার চিপা গলি গুলা আর শত শত ইলেক্টিকের তার! এঁকে রাখলাম!

এভাবে একে একে আমরা আমাদের রেয়ারেন্স লাইব্রেরী বানাবো। আর চাইলে সাথে মোবাইলে ছবি তুলেও ছবি রেখে দেয়া যেতে পারে।
- ক্লিন আপঃ

তো স্কেচবুকিং এ জেশ্চার ড্রইং এর মাধ্যমে মানুষের অঙ্গভঙ্গি শিখতে পারবো, এর সাথে ফর্ম ড্রইং এর মাধ্যমে আমরা আস্তে আস্তে নিজের স্টাইলটাকে এক্সপ্লোর করবো , ক্যারাক্টার স্টাডি আর ব্যাক গ্রাউন্ড স্টাডির মাধ্যমে আমরা ফাইনালী দারুন দারুন সব কার্টুন আর কমিক্স বানাবো।
তুমি যদি নতুন স্কেচবুকিং করো তাহলে আমি সাজেশন দিবো প্রথমে এই জেশ্চার ড্রইং, ক্যারাক্টার স্টাডি সব একসাথে না করে, টার্গেট নিয়ে একেকটা কয়েক মাস ধরে করো। ধরো ১ মাস আগে জেশ্চার প্রাক্টিস করলা তারপর ক্যারাক্টার স্টাডিতে গেলা। মনে রাখতে হবে এইটা একটা লং প্রসেস। তাই আবার একদিন দুইদিনে অধর্য হয়ে গেলেও হবে না। আর তাই এই সব নিয়ম কানুনের বাইরে সবার আগে স্কেচবুকিং এ যেটা করতে হবে সেটা হলো স্কেচবুকিং এর টাইম টা উপোভোগ করতে হবে, আঁকাআকি টা উপভোগ্য হওয়া জরুরি। যেমন এই সব ড্রইং প্রাক্টিসের মাঝে এই স্কেচ বুকেই আমি কখনো রঙ নিয়ে খেলি, অথবা ট্রাভেল লগ লিখি আবার এই স্কেচ বুকই হয়ে ওঠে আমার যতসব পাগলাটে বুদ্ধির আড্ডাখানা।
স্কেচবুকে ড্রইং নিয়ে আজকে এই পর্যন্তই! আর এই স্কেচবুকে আইডিয়া নিয়ে কিভাবে কাজ করি সেটা আরেকদিন বলবো।
(লেখাটা এখনো শেষ হয়নি, এক্সাম্পল হিসেবে আরও ছবি যুক্ত হবে আরও এডিট হবে কিছু সেকশন। আপডেটেড থাকতে এক সপ্তাহ পর পর আবার এসে লেখাটা পড়ে যেতে পারো।)
(বিঃদ্রঃ তুমি যদি ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা খুলনায় থাকো তাইলে প্রতি শনিবার Cartoon People এর এই
#SketchbookSaturday তে খাতা কলম নিয়ে চলে আসতে পারো নিজের হাতটা শানিয়ে নিতে! :D)
(বিঃদ্রঃ২ঃ এই লেখাটা পড়ার পর কিছু না বুঝলে কিংবা Sketchbooking নিয়ে তোমাদের আরো কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে জানাও আমি সেগুলা এখানেই নিচে জমাচ্ছি ও পরবর্তি পোস্টে সবগুলার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হবে।)
Frequently asked questions (FAQ) :
*আচ্ছা, স্কেচবুকিং আমরা বাইরে রাস্তায় করি কেন? স্কেচবুকিং কি বাসায় করা যাবে না, নাকি শুধু বাইরেই করতে হয়?
*স্কেচবুকিং না করে গুগল করে দেখে আঁকলেই তো হয়?
* স্পটে বসে না এঁকে ছবি তুলে নিয়ে গেলে হয়না পরে আঁকার জন্য?
*আমরা জেশ্চার এ কুইক ড্রইং করি কেন? এটা আমরা আস্তে আস্তে করতে পারি না?
*জেশ্চার আঁকতে গেলে মানুষ জন শুধু সরে যায়! আঁকতে পারি না। কি করবো?
*আমার আঁকা মানুষ গুলা রবোটের মতো হয়। কিভাবে ঠিক করবো?
*ফর্ম আর শেইপ কি?
*আমি কি জেশ্চার ড্রইং, ক্যারেকটার স্টাডি, ব্যাকগ্রাউন্ড সব এক সাথে করতে পারি না?
*স্কেচবুক টিপ্সঃ আমি আগে কখনো আউটডোরে আকাআকি করিনি কি কি করলে ব্যাপারটা আরও সহজ হবে টিপস দিলে ভালো হতো।